কেন
১,৩০০ কিলোমিটার সাঁতরে বাংলাদেশে আসে ইলিশ?
নোনা
পানির ইলিশ ডিম পাড়তে নদীর উজান পেরিয়ে আসে মিঠা পানিতে। এরপর আবার ডিম ছাড়া শেষে তারা ভাটিতে ভেসে ধরে সাগরের পথ।
ছবি: সংগৃহীত |
‘রুপার
পাতে মারে ঘা, পানির বুকে ফেলল পা।‘
বলুন
তো, কীসের কথা বলছি?
পারছেন
না? বেশ, ধাঁধাটি বরং আমিই সমাধান করে দিই। বলছি ইলিশের কথা।
বিশ্ব
মানচিত্রে বাংলাদেশের ‘একান্ত আপনার‘ হিসেবে গৌরব করার মতো যে কয়টি জিনিস
রয়েছে, তাদের মধ্যে একটি হলো ইলিশ।
এ
দাবি প্রতিবছর বৈশ্বিক মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশে
ধরা হয় বলেই শুধু
নয়। জামদানির পর ২০১৭ সালে
বাংলাদেশের দ্বিতীয় জিওগ্রাফিক্যাল আডেন্টিফিকেশন (জি–আই) বা
ভৌগলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি পায় ইলিশ। ফলে ‘বাংলাদেশের ইলিশ‘ শব্দদ্বয় এখন যেমন শ্রুতিমধুর, তেমনই যুক্তিযুক্ত।
তবে
পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলসহ গোটা দেশব্যাপী পান্তা–ইলিশ খেয়ে নববর্ষ উদযাপন কিংবা ইলিশের মৌসুমে সরষে ইলিশ, ভাজা ইলিশ, ইলিশ পাতুরি, ইলিশ ঝোল, ইলিশ পোলাও, ইলিশ খিচুড়ি, ইলিশ ভুনা, কাঁচকলায় ইলিশের মতো নিত্যনতুন পদ রেঁধে উদরপূর্তি
ছাড়াও, আরও অনেক কিছুই জানার আছে ‘মাছের রাজা‘ ইলিশ সম্পর্কে।
ইলিশকে বলা হয় ‘মাছের রাজা‘। |
শুরু
করা যাক ইলিশের নাম সম্পর্কে একটি চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে। এখন একে ইংরেজিতে ‘হিলশা‘ বলে অভিহিত করা হলেও, আগে কিন্তু এর ছিল অন্য
একটি নাম – ইন্ডিয়ান শ্যাড। কেননা এটি ক্যালপিডাই শ্যাড পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।
অন্য
অনেক জায়গায় আবার আছে ইলিশের হরেক রকম নাম। শ্যাড, মদার, বিম, পাল্লা, পোলাসা, গাঙ্গ, কাজলগৌরী, জলতাপী, মুখপ্রিয়া, চাসকি, চাসিস, মোদেন, পালভা। আবার সিন্ধু অঞ্চলে ইলিশের নাম পাল্লা। গুজরাটে ইলিশকে ডাকা হয় মোদেন ও
পালভা নামে। তেলেগু ভাষায় এর নাম পোলাস,
তামিলে ওলাম, কন্নড় ভাষায় পালিয়া, মারাঠিতে পলা। ইরাকে এটি স্বুর, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে এটি
তেরুবক নামে পরিচিত।
আমাদের
বাংলাদেশ তিন ধরনের ইলিশের প্রাপ্তিস্থান। মৎস্য বিশেষজ্ঞ দিগেন বর্মণও তাঁর ‘ইলিশ পুরাণ‘ বইতে লিখেছেন, পদ্মায় তিন রকম ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। তাদের নাম : পদ্মা ইলিশ, চন্দনা ইলিশ ও গুর্তা ইলিশ।
সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রজাতি পদ্মা ইলিশ। |
এদের
মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রজাতি পদ্মা ইলিশ, যার বৈজ্ঞানিক নাম হলো টেনুয়ালোসা ইলিসা। এই ইলিশের বাস
সাগরে। সেখান থেকে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে নদীতে আসে তারা ডিম ছাড়তে। বাচ্চারা একটু বড় হলে ফের
ফিরে যায় সাগরে। তবে বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় টেনুয়ালোসা ইলিসা।
চন্দনা
ইলিশের বৈজ্ঞানিক নাম নেনুয়াকোসা টোলি। একসময় বঙ্গোপসাগর ও মেঘনার মোহনায়
প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত এই ইলিশ। কিন্তু
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত ইলিশ ও জাটকা ধরার
ফলে হ্রাস পেয়েছে এই ইলিশের পরিমাণ।
চন্দনা
প্রজাতির ইলিশ মাছ লিঙ্গ পরিবর্তন করে পুরুষ মাছ স্ত্রী মাছে রূপান্তরিত হয়। এ প্রজাতির ২২.০ সে.মি.
আকার পর্যন্ত সকল মাছই পিরিষ, ২২.০ সে.মি. হতে ২৫/২৬ সে.মি. আকারের মাছের লিঙ্গ পরিবর্তন ঘটে এবং ২৬ সে।মি। এর
ঊর্ধ্ব আকারের সকল মাছই স্ত্রী।
গুর্তা
ইলিশের বৈজ্ঞানিক নাম হিলশা কেলি। এই নির্দিষ্ট মাছের
প্রজাতিটি নদীতে আসে না। তাই এদের পাওয়া যায় কেবলই সমুদ্রে।
মাওয়ার শিমুলিয়া ফেরিঘাটে ইলিশ ভাজা। |
প্রশ্ন জাগতে পারে, নদী নাকি সমুদ্র – কোথাকার ইলিশের স্বাদ বেশি। উত্তরটি হবে নদীর, বিশেষত পদ্মার ইলিশের।
সমুদ্রের
লবণাক্ত পানি থেকে ইলিশ যত নদীর উজানে
যেতে থাকে, ততই তার শরীর থেকে আয়োডিন লবণ ঝরতে থাকে। দীর্ঘ পথ চলে যত
সে মিষ্টি পানিতে থাকে, ততই কমে তার দেহের চর্বি, লবণ, খনিজ। এর ফলে বাড়ে
স্বাদ। তাই তো অন্য অনেক
সামুদ্রিক মাছের অগণিত গুণগ্রাহী থাকলেও, সমুদ্রের ইলিশের ভক্ত খুঁজে পাওয়া ভার।
অনেকেরই
দাবি, চাঁদপুরে যেখানে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর
মোহনা সেখানকার ইলিশই সেরা। সব ইলিশের সেরা
এই ইলিশের শরীরভর্তি চর্বি, স্বাদও অনন্য সাধারণ।
আবার
গবেষণা করে একদল বিজ্ঞানী বলেছেন স্বাদে ও পুষ্টিতে মেঘনার
মোহনার মাছ শুধু দেশের মধ্যেই নয়, বিশ্বসেরা। আর আগস্ট থেকে
নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে পুষ্টি ও স্বাদে সেরা
ইলিশগুলো ধরা পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাসাগর গবেষণা সংস্থা (নোয়া) থেকে পাওয়া ১৯৯৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস
এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের
ওশানোগ্রাফি বিভাগের চারজন গবেষক।
মেঘনায় ধরা পড়া ইলিশ। |
অন্যান্য
মাছের তুলনায় অনেকটাই ব্যতিক্রমধর্মী ইলিশের জীবনচক্র। নোনা পানির ইলিশ ডিম পাড়তে নদীড় উজান পেরিয়ে আসে মিঠা পানিতে। এরপর আবার ডিম ছাড়া শেষে তারা ভাটিতে ভেসে ধরে সাগরের পথ। পড়ে থাকে না সদ্য ডিম
ফুটে মাছ হওয়া জাটকাও। মায়েদের সঙ্গে তারাও যোগ দেয় রোমাঞ্চকর যাত্রায়।
সাঁতারু
হিসেবে ইলিশের দক্ষতা ঈর্ষণীয়। ঘণ্টায় ছুটতে পারে ৭১ কিলোমিটার বেগে।
বর্ষা ও শীত মৌসুমে
ডিম ছাড়ার জন্য তারা এমনকি ১,২০০–১,৩০০ কিলোমিটারও পাড়ি দেয় অনায়াসে। অবশ্য পানির গভীরতা যদি ৪০ ফুট হয়,
তাহলে স্বাচ্ছন্দ্যে সাঁতার কাটতে পারে। উজান বাওয়ার সময় কিছুই তোলে না মুখে। একেকটি
ইলিশ ডিম ছাড়তে পারে ২০ লাখ পর্যন্ত।
২০১৮
সালে ইলিশ মাছের জীবনরহস্য উন্মোচন (জিনোম সিকোয়েন্স) করেছে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের দুটি দল। একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাসিনা খানের নেতৃত্বে গবেষক দল, অন্যটি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল আলমের নেতৃত্বে গবেষক দল। তারপরও কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে ইলিশকে এখনও একটি ‘রহস্যময় মাছ‘ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
কথায় আছে, ‘আড়াই লাফে ইলিশ মরে। |
আছে, ‘আড়াই লাফে ইলিশ মরে।‘ কেননা, বাংলাদেশের জাতীয় মাছ পানি থেকে ডাঙায় তোলার পরপরই মারা যায়। কিন্তু কী এর কারণ?
প্রথমত,
আলো ও তাপমাত্রার প্রতি
এরা অতি মাত্রায় সংবেদনশীল। একদমই সহ্য করতে পারে না। তাই পানি থেকে তোলার সঙ্গে সঙ্গেই এরা মারা যায়।
দ্বিতীয়ত,
অন্যান্য অধিকাংশ মাছের মতো তাদের পটকা নেই। পটকার সাহায্যে মাছ পানিতে ভাসতে ও অক্সিজেন ধরে
রাখতে পারে। কিন্তু যেহেতু ইলিশের পটকা নেই, তাই ডাঙায় ওঠার পর খুব দ্রুতই
তারা অক্সিজেনের অভাবে মারা পড়ে।
কিন্তু
মজার ব্যাপার হলো, শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে বিরল
কিছু মাছ ঠিকই বেঁচে থাকতে পারে ডাঙায় ওঠানোর পর দীর্ঘ সময়।
যেমন বরিশালের হিজলায় মেঘনার বুক থেকে ধরা রূপালী ইলিশগুলোকে কিন্তু পানি থেকে তোলার ঘণ্টাখানেক পরও দিব্যি লাফাতে দেখা যায়।
নদীতে জেলেদের নৌকা। ছবি: মুমিত এম |
ইলিশের
আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, একে সবসময়ই সাঁতরে বেড়াতে দেখা যায়। কারণ, ইলিশ জীবনধারণ করে উচ্চ উৎপাদনশীল বিভিন্ন প্ল্যাঙ্কটন যেমন নীল–সবুজ শৈবাল, ডায়াটম, ডেসমিড, কোপিপোড, রটিফার খেয়ে। এজন্য এদেরকে সার্বক্ষণিক এক স্থান থেকে
আরেক স্থানে যেতে হয়, অন্যান্য মাছের মতো এক জায়গায় স্থির
থাকতে পারে না। ডিমও ছাড়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে।
মাছ
ছাড়া ইলিশও কিন্তু সচরাচর দেখা যায় না। আমাদের দেশে যেহেতু এত পরিমাণ ইলিশ
মাছ ধরা পড়ে, তাহলে তো এমন অনেক
ইলিশ মাছও ধরা পড়া উচিত যারা ইতোমধ্যেই ডিম পেড়ে ফেলেছে। একবার ডিম পাড়া হয়ে গেলে ইলিশরা যখন সাগরে ফিরে যায়, তখন তাদের একটা অংশ কি জেলেদের জালে
ধরা পড়ে না? নাকি ডিম পাড়ার পরই কি তারা মারা
যায়? এবং পুরুষ ইলিশরাই বা যায় কই?
ইলিশ
গবেষক ড. মো. আনিসুর
রহমান বলেন, ডিমছাড়া বা ইতোমধ্যেই ডিম
পেড়ে ফেলা ইলিশও জেলেদের জালে ধরা পড়ে ঠিকই। কিন্তু ওইসব ইলিশ এতটাই স্বাস্থ্যহীন, কৃশকায় হয় যে, তাতে
খুব একটা দাম ওঠে না। তাই জেলেরা ওইসব ইলিশ বাজারে আনেন না। হয় তারা নিজেরাই
সেগুলো খেয়ে ফেলেন, কিংবা টুকরো টুকরো করে তাতে লবণ মাখিয়ে নোনা ইলিশ তৈরি করেন।
পরিণত পুরুষ ইলিশ। |
এদিকে
পুরুষ ইলিশ কেন দেখা যায় না, এই প্রশ্নের উত্তর
খোঁজার চেষ্টা করেছেন সাংবাদিক ও জনপ্রিয় বিজ্ঞানের
লেখক আব্দুল কাইয়ুম।
তিনি
জানান, “কয়েকজন জেলে ও বিশেষজ্ঞের সঙ্গে
কথা বলে আমি জানতে পারি, আসলে আমরা পুরুষ ইলিশকে যতটা বিরল ভাবি ততটা তারা নয়। জেলেরা তাদের জালে পুরুষ ইলিশও ধরেন, কিন্তু তারা বলতে পারেন না মাছটি পুরুষ
না নারী, কেননা পুরুষ ইলিশের কোনো জননাঙ্গ নেই।“
পুরুষ
ইলিশের জননাঙ্গ না থাকলে, ইলিশ
কি যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হয় না? সত্যিই
তা–ই। পুরুষ ইলিশরা
পানিতে ফোমের মতো শুক্রাণু ত্যাগ করে, এবং নারী ইলিশরা ওই ফোম–সদৃশ
ব্রথের উপর ডিম্বানু নিঃসৃত করে সেগুলোকে নিষিক্ত করে।
আর
ইলিশ যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত না হলেও, তাদের
১,২০০–১,৩০০ কিলোমিটার
পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসার পেছনে মূল কারণ কিন্তু যৌন তাড়নাই!
মৎস্য
সম্পদ সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করে ওয়ার্ল্ডফিশ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। সেখানকার ইলিশ বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল ওয়াহাব
বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে,
“নদীর
শক্তিশালী স্রোতের ফলে নারী ও পুরুষ উভয়
ইলিশের শিরদাঁড়া বেয়েই শিহরণ বয়ে যায়। এতে তারা তীব্র যৌন উদ্দীপনা অনুভব করে, ফলে তুমুল বেগে উজান বেয়ে সাঁতরাতে থাকে।“
Discover more from Bangovumi
Subscribe to get the latest posts to your email.